অভিশপ্ত বাড়ি
ঢাকার শহরতলির একটু বাইরে, একটি ছোট গ্রামে অবস্থিত একটি পুরনো দোতলা বাড়ি—লোকে যাকে ডাকে “কালোবাড়ি” নামে। বাড়িটি বহু বছর ধরে পরিত্যক্ত। কেউ সেখানে থাকে না, গেলেই নাকি অদ্ভুত আওয়াজ, কোলাহল, এমনকি মাঝে মাঝে কান্নার শব্দ পর্যন্ত শোনা যায়। গ্রামের মানুষ রাতে ওদিক মাড়ায় না।
সেই বাড়ির গল্পটা শুরু হয় অনেক বছর আগে।
১৯৮৭ সাল। গ্রামের এক বিত্তবান ব্যক্তি, কাজী আবদুল মতিন, বাড়িটি তৈরি করেন তাঁর পরিবারের জন্য। দুই ছেলে, এক মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে ছিল তাঁর সুখের সংসার। কিন্তু হঠাৎ এক রাতে তাঁদের ছোট মেয়েটি—মায়া—আকস্মিকভাবে নিখোঁজ হয়ে যায়। দিনরাত খোঁজ করেও তাঁরা মেয়েকে খুঁজে পান না। গ্রামের মানুষ বলে, কেউ একজন নাকি মায়াকে রাতে জানালা দিয়ে ডেকেছিল, আর সে নাকি সেই অচেনা আওয়াজের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির পেছনের জঙ্গলে হারিয়ে গিয়েছিল।
এরপর থেকেই শুরু হয় বাড়ির ভেতর অদ্ভুত সব ঘটনা।
প্রথমে কাজী সাহেবের স্ত্রী আত্মহত্যা করেন, তারপর একে একে তাঁর ছেলেরাও রহস্যজনকভাবে মারা যায়। আর একদিন হঠাৎ করে কাজী আবদুল মতিন নিজেও নিখোঁজ হয়ে যান। এরপর থেকে সেই বাড়ি আর কেউ ভাড়া নেয়নি, কেউ কিনতেও চায়নি। ভূতের ভয়ে লোকজন দূরে থাকত।
বর্তমান সময়
২০২5 সাল। রাফি নামের এক তরুণ সাংবাদিক শহর থেকে গ্রামে আসে। তার উদ্দেশ্য—লোককথা ও ভূতের গল্প নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি বানানো। সেই সূত্রেই সে জানতে পারে কালোবাড়ির কথা।
রাফি ভাবল, “একটা রাতে যদি বাড়িটায় থাকতে পারি, তাহলে হয়তো কিছু প্রমাণ জোগাড় করতে পারব।”
সে গ্রামের চেয়ারম্যানের অনুমতি নিয়ে এক রাতের জন্য বাড়িটিতে থাকতে চায়। চেয়ারম্যান প্রথমে আপত্তি করলেও রাফির জেদের কাছে হার মানেন।
রাত ৮টা। রাফি ক্যামেরা, মাইক্রোফোন আর টর্চলাইট নিয়ে প্রবেশ করল কালোবাড়িতে। ভেতরে ঢুকতেই তার মনে হলো, যেন কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে। দেয়ালের রং খসে পড়েছে, ছাদের কোণে ঝুলছে মাকড়সার জাল, আর বাতাসে এক ধরনের গন্ধ—পুরনো কাগজ, ধুলো আর কিছু যেন আরও গভীর কিছু।
সে ক্যামেরা সেট করে কথা বলতে লাগল, “আমি এখন কালোবাড়িতে, এই বাড়ির ইতিহাস ভয়াবহ। আমি এখানে রাত কাটাবো এবং যা ঘটবে সব রেকর্ড করব।”
প্রথম কিছুক্ষণ কিছুই ঘটল না। রাত ১১টার দিকে, হঠাৎ একটা দরজা সশব্দে খুলে গেল। রাফি ভয়ে চমকে উঠলেও সাহস করে দরজার দিকে এগোল। দরজার ওপাশে একটা ছোট ঘর, একটুখানি আলো ফাঁক দিয়ে এসে পড়ছে জানালার কাচ ভেঙে। ঘরের মধ্যে একটি টেবিলের উপর একটি ডায়েরি পড়ে আছে।
রাফি ডায়েরিটা খুলল। প্রথম পাতায় লেখা,
“আমি মায়া। যদি কেউ এটা পড়ে, জেনে রেখো, আমাকে তারা নিয়ে গেছে। তারা অন্ধকারে বাস করে, দেয়াল ভেদ করে হাঁটে।”
রাফির গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
সে ভাবল, “এই ডায়েরি কি সেই নিখোঁজ হওয়া মায়ার?”
সে পড়তে লাগল। প্রতিটি পাতায় লেখা ভয়ানক সব অভিজ্ঞতা—কিভাবে রাত হলেই একটা ছায়ামূর্তি এসে তার জানালায় দাঁড়াত, ফিসফিস করে কথা বলত, কীভাবে এক রাতে সেই ছায়ামূর্তির হাত ধরে সে বেরিয়ে পড়ে আর ফিরতে পারেনি।
হঠাৎ করেই সে দেখতে পেল ক্যামেরার ফ্রেমে পিছনে কিছু একটা নড়ছে।
সে ঘুরে দাঁড়াতেই, একটা কালো ছায়া সরে গেল দ্রুত। সে দৌড়ে ক্যামেরা হাতে নিয়ে ছুটে গেল সেই দিকটায়, কিন্তু কিছুই পেল না। তবে একটা দরজা খোলা পাওয়া গেল, নিচতলায় যাওয়ার গোপন সিঁড়ি।
সিঁড়িটা মাটির নিচে চলে গেছে, অনেক পুরনো কাঠের গন্ধে ভরা।
রাফি সাহস করে নিচে নামল।
নিচে গিয়ে সে দেখতে পেল ছোট একটা ঘর, আর সেই ঘরের দেয়ালজুড়ে ছড়ানো পুরনো ছবি—মায়া, তার মা, তার ভাইরা। কিন্তু ছবিগুলো সব বিকৃত, মায়ার মুখ আঁচড়ে কাটা, যেন কেউ জোর করে তার মুখ মোছে দিয়েছে।
আরেক কোণে রাখা একটা আয়নায় সে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেল—কিন্তু আয়নায় সে একা নয়, পেছনে একটি মেয়ের ছায়া দাঁড়িয়ে।
সে ঘুরে দেখল—কেউ নেই। আবার আয়নায় তাকাল—ছায়া এবার আরেকটু কাছে।
হঠাৎ করে বাতি নিভে গেল।
চারদিক অন্ধকার, শুধু ক্যামেরার ইনফ্রারেড আলোয় কিছু দেখা যাচ্ছে। ক্যামেরায় সে দেখল, পেছনে একটা ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে তার দিকে।
রাফি আতঙ্কে দৌড়াতে লাগল, সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠল, কিন্তু দরজা বন্ধ!
বাড়ির মধ্যে তখন কান্নার শব্দ, শিশির মতো হাসি, ছাদের উপর পা ফেলার শব্দ, জানালায় কেউ ঠুকছে বারবার।
তারপর, হঠাৎ সব থেমে গেল।
পরদিন সকাল
গ্রামের কিছু লোক পুলিশসহ বাড়িতে ঢোকে। তারা খুঁজে পায় ক্যামেরা, কয়েকটা কাগজ, আর নিচতলার সেই ঘর।
কিন্তু রাফি নেই। সে আর কোনোদিন ফিরে আসেনি।
তবে ক্যামেরার ফুটেজে স্পষ্ট দেখা যায়, রাফি একজন মেয়ের ছায়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, আর তারপর সেই ছায়া ধীরে ধীরে তাকে আচ্ছন্ন করে।
লোকজন আবার বলতে শুরু করল—"বাড়িটা অভিশপ্ত, ওখানে কারও ফিরবার পথ নেই…"
শেষ কথা
এরপর থেকে কেউ আর সেই বাড়ির কথা মুখেও আনে না। বাড়িটা এখন আরও বেশি নীরব, কিন্তু রাতের গভীরে যদি কান পাতো, শোনা যায় এক তরুণের দম বন্ধ হওয়ার আওয়াজ আর এক ছোট্ট মেয়ের ফিসফিস…
“আমাকে ফিরিয়ে নাও…”
0 Comments