“ছায়ার বাড়ি”
রাত তখন প্রায় ২টা। গ্রামে গভীর নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। শুধু মাঝে মাঝে কুকুরের ডাকে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে কারো কারো। এমন রাতেই রাফি তার বন্ধুদের সাথে শহর থেকে ফিরছিলো মোটরসাইকেলে করে। একটা ছোট্ট, ঘন জঙ্গলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ তার বাইক বন্ধ হয়ে যায়।
"দোস্ত, এই জায়গাটা তো ভয়ংকর রকম অন্ধকার," নাঈম বলে উঠলো।
"এইখানে নাকি একটা পুরানো বাড়ি আছে, যেটা এখন কেউ যায় না... ভূতের বাড়ি," মাহির কাঁপা কণ্ঠে বলল।
রাফি হাসতে হাসতে বলল, "আরে ভূত-ফুত বলে কিছু নাই। তুই ভয় পাস?"
কিন্তু বাইক আর স্টার্ট নিচ্ছে না। ঠিক তখনই, গাছের পেছন থেকে একটা ছায়ামূর্তি দেখা গেল। ছায়াটা নড়ছে, কিন্তু কোনো শব্দ নেই। রাফি মোবাইলের ফ্ল্যাশ অন করতেই, কেউ নেই।
“আমরা হেঁটে চলে যাই, বাইক পরে দেখে নেব,” নাঈম বলল।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা সেই পুরানো বাড়িটার কাছে চলে আসে। বাড়িটা জঙ্গলের ভেতরে অর্ধভাঙা, জানালাগুলো যেন চোখের মতো ঘোরাফেরা করছে। কৌতূহলবশত ওরা ভিতরে ঢুকে পড়ে। দরজাটা এমনভাবে খোলা, যেন কেউ ঢোকার অপেক্ষায় ছিল।
ঘরে ঢুকতেই ঠান্ডা হাওয়া বয়ে যায়। মেঝেতে ধুলাবালি, কিন্তু একটা জায়গায় পায়ের ছাপ—তা একদম তাজা!
মাহির বলল, "দেখো! কেউ কিছুক্ষণ আগেই হেঁটে গেছে এই পথ দিয়ে!"
হঠাৎ ওপরের তলার সিঁড়ি থেকে কাঠের আওয়াজ আসে—'কড়... কড়... কড়'। কারো ভারী পা চলার শব্দ। ওরা চুপ করে দাঁড়িয়ে যায়। হঠাৎ একটা ছায়া সিঁড়ির ওপর থেকে তাকায়। তার চোখ লাল, পোশাক ছেঁড়া-ফাটা, আর মুখে হাড়গোড়ের মত ফাঁকা শূন্যতা।
"দৌড়!"—এই শব্দটা মনে হতেই সবাই ছুটে পালাতে চায়, কিন্তু দরজা তখন বন্ধ। বাইরের দরজা নিজে নিজেই বন্ধ হয়ে গেছে, আর খুলছে না।
ওরা খুঁজে খুঁজে একটা জানালা দিয়ে বের হবার চেষ্টা করছিলো। হঠাৎ মাহির চিৎকার—"আআআ!!"
ওরা ফিরে তাকিয়ে দেখে, মাহির পা কিছু একটা ধরে টানছে।পা পর্যন্ত কালো ধোঁয়ার মতো একটা হাত! রাফি আর নাঈম মিলে মাহির হাত ধরে টানতে টানতে কোনোভাবে ওকে ছাড়িয়ে আনে। মাহির মুখ তখন ফ্যাকাশে, সে কিছু বলতে পারছিল না।
জানালা ভেঙে ওরা তিনজন বেরিয়ে আসে। সেই মুহূর্তে যেন বাতাস স্তব্ধ, চারদিক নিস্তব্ধ। বাইক হঠাৎ করেই স্টার্ট নেয়।
তারা গ্রামে ফিরে আসে, কিন্তু মাহির অবস্থা ভালো না। রাতে সে ঘুম থেকে উঠে চিৎকার করে—"ছায়াটা আবার এসেছে!" এরপর থেকে মাহির জীবন পাল্টে যায়। সে কারো সাথে কথা বলে না, একা একা বসে থাকে।
গ্রামের এক বৃদ্ধ কবিরাজ বললেন, “তোমরা ভুল করে ওদের জায়গায় ঢুকে গেছো। ওই বাড়ি ছায়াদের, মানুষের নয়। যারা একবার ওদের দেখে, তারা আর সহজে মুক্তি পায় না।”
রাফি ও নাঈম সিদ্ধান্ত নেয়, তারা সেই বাড়িতে আবার যাবে—মাহির মুক্তির জন্য। কবিরাজ তাদের একটা তাবিজ দেন, আর বলেন, "ছায়াদের ভয় পেও না, ভয় দেখালে ওরা শক্তি পায়। সাহস ধরে থাকো।"
দুদিন পর রাতে ওরা আবার বাড়িতে যায়। রাত তখন ৩টা। এবার ওদের সঙ্গে কয়েকটা মোমবাতি, তাবিজ, আর সাহস। ভেতরে ঢুকতেই ওরা আবার ঠান্ডা বাতাস অনুভব করে, আর একটা কর্কশ হাসি—“হি হি হি…”
মাঝখানের ঘরে গিয়ে দেখে, একটা আয়না। আয়নার ভেতরে তিনজনই দাঁড়িয়ে, কিন্তু আয়নায় দেখা যাচ্ছে চারজন! চতুর্থজনটা কার?
আস্তে আস্তে আয়নার ভেতর থেকে সেই ছায়ামূর্তি বেরিয়ে আসে—এবার একদম স্পষ্ট। মুখে হাঁসি, হাতে আগুনের মতো আলোর বল।
রাফি তাবিজটা সামনে ধরে, মন্ত্র পড়তে থাকে। ছায়াটা কেঁপে ওঠে, যেন আলো তাকে পোড়াচ্ছে। সে চিৎকার করে বলে, “তোমরা চলে যাও... কিন্তু সে আমার... ও এখন আমার মধ্যেই আছে...”
তারা বুঝে যায়, মাহির দেহে সে প্রবেশ করেছে।
তবে সাহস আর তাবিজের শক্তিতে ছায়াটা হার মানে। ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে যায়। বাড়িটা হঠাৎ কেঁপে ওঠে, তারপর নিস্তব্ধ।
তারা মাহির দিকে তাকিয়ে দেখে, ওর চোখে আবার আলো ফিরে এসেছে। যেন ঘুম ভাঙছে।
সেই বাড়ি এরপর ভেঙে ফেলা হয়। কিন্তু মাঝে মাঝে রাতে, কেউ কেউ বলে—“জঙ্গলের ভেতর এক ছায়া এখনো হেঁটে বেড়ায়… কে জানে, সে পুরোপুরি চলে গেছে কি না।”
0 Comments