ভয়ংকার ভূতুড়ে জমিদার বাড়ি
গভীর রাতে, নিস্তব্ধ গ্রামে, পুরনো এক জমিদার বাড়ির ধ্বংসস্তূপের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে সেখানে গিয়েছিলাম ভূতের গল্প শোনার লোভে। জীর্ণ দেওয়ালগুলো যেন শতাব্দীর সাক্ষী, তাদের গায়ে জমা ধুলো আর শ্যাওলার স্তর ভেদ করে কেমন যেন একটা শীতল বাতাস ভেসে আসছিল। পূর্ণিমার আবছা আলোয় সবকিছু রহস্যময় লাগছিল।
আমার বন্ধু রবিন, যে কিনা ভূতের গল্প বলতে ওস্তাদ, শুরু করলো তার গা ছমছমে কাহিনি। পুরনো জমিদার বাড়িতে নাকি এক অভিশপ্ত আত্মা ঘুরে বেড়ায়। বহু বছর আগে, এই বাড়ির মালিক, প্রতাপশালী জমিদার তার সুন্দরী স্ত্রীকে সন্দেহ করতেন এবং একদিন গভীর রাতে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেন। সেই থেকে নাকি স্ত্রীর আত্মা মুক্তি পায়নি, আজও সে তার হত্যাকারীর খোঁজে ফেরে।
রবিনের গল্প শেষ না হতেই আমরা একটা ঠান্ডা স্রোত অনুভব করলাম। চারপাশের ঝিঁঝি পোকার ডাক হঠাৎ থেমে গেল। কেমন যেন একটা অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এলো। আমরা একে অপরের দিকে তাকালাম, সবার চোখেই চাপা ভয়।
হঠাৎ, দূরে ভাঙা দেওয়ালের ওপাশে একটা আবছা নারী মূর্তি দেখা গেল। লম্বা চুল, সাদা পোশাক, চাঁদের আলোয় অস্পষ্ট হলেও তার অবয়ব যেন চেনা চেনা লাগছিল। আমাদের বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল। রবিন ঢোক গিলে ফিসফিস করে বলল, "ওটাই... সেই আত্মা!"
মূর্তিটা ধীরে ধীরে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। তার পা যেন মাটিতে পড়ছে না, মনে হচ্ছিল ভেসে আসছে। আমরা পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম, কারও মুখে কোনো কথা নেই। ভয় যেন আমাদের কণ্ঠরোধ করে দিয়েছে।
কাছে আসার পর মূর্তিটা থামলো। চাঁদের আলো এবার তার মুখের ওপর পড়লো। ফ্যাকাসে মুখ, গভীর কালো চোখ, আর ঠোঁটের কোণে এক বিষণ্ণ হাসি। সে ক্ষীণ স্বরে ডাকলো, "কে... তোমরা?"
আমরা তখনও ঘোর কাটাতে পারিনি। রবিন সাহস করে বলল, "আমরা... আমরা এখানে ঘুরতে এসেছি।"
নারী মূর্তিটি কিছুক্ষণ আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর ধীরে ধীরে বলল, "এই বাড়ি অভিশপ্ত। এখানে থেকো না। চলে যাও।" তার কণ্ঠস্বর এতটাই করুণ ছিল যে আমাদের ভয় কিছুটা কমল, তবে অস্বস্তি কাটলো না।
আমরা আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালাম না। যে যেদিকে পারলাম দৌড় দিলাম। পিছনে তাকিয়ে দেখলাম, সেই নারী মূর্তি তখনও সেখানেই দাঁড়িয়ে, চাঁদের আলোয় একা।
পরের দিন সকালে আমরা আবার সেই বাড়িতে গিয়েছিলাম দিনের আলোয়। ধ্বংসস্তূপের চারপাশ শান্ত, স্বাভাবিক। রাতের সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা যেন স্বপ্ন মনে হচ্ছিল। কিন্তু কাল রাতের সেই শীতল বাতাস, সেই আবছা মূর্তি, সেই করুণ কণ্ঠস্বর – সবকিছুই তো সত্যি ছিল।
এরপর অনেক বছর কেটে গেছে। আমি সেই রাতের কথা ভুলিনি। মাঝে মাঝে মনে হয়, সত্যিই কি আমরা কোনো অভিশপ্ত আত্মার দেখা পেয়েছিলাম? নাকি ওটা আমাদের মনের ভুল ছিল?
কয়েক বছর পর, আমি সেই গ্রামে আবার গিয়েছিলাম। পুরনো জমিদার বাড়ির কাছে গিয়ে জানতে পারলাম, স্থানীয়রা আজও রাতে ঐ বাড়ির ধারেকাছে যায় না। তারা বিশ্বাস করে, সেই জমিদারের স্ত্রীর আত্মা এখনও সেখানে কাঁদে।
একদিন, গ্রামের এক বৃদ্ধের কাছে সেই জমিদার ও তার স্ত্রীর ব্যাপারে জানতে চাইলাম। বৃদ্ধ লোকটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, "হ্যাঁ বাবা, করুণ কাহিনি। জমিদার তার স্ত্রীকে বিনা কারণে সন্দেহ করত। একদিন রাতে রাগের মাথায় তাকে ধাক্কা দেয়, আর সে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পায়। সঙ্গে সঙ্গেই সব শেষ।"
আমি জিজ্ঞেস করলাম, "তাহলে কি তার আত্মা এখনও ঘুরে বেড়ায়?"
বৃদ্ধ লোকটি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, "কে জানে বাবা। তবে শুনেছি, পূর্ণিমা রাতে নাকি এখনও তার কান্নার আওয়াজ শোনা যায়।"
আমার মনে কাল রাতের সেই মূর্তির বিষণ্ণ মুখের ছবি ভেসে উঠলো। তার সেই করুণ ডাক, "এই বাড়ি অভিশপ্ত। এখানে থেকো না।"
এরপর আমি আরও কিছু দিন সেই গ্রামে ছিলাম। একদিন রাতে, সাহস করে একাই গেলাম সেই পুরনো বাড়ির দিকে। পূর্ণিমা রাত ছিল। চারপাশ শান্ত, শুধু ঝিঁঝি পোকার একটানা ডাক শোনা যাচ্ছিল।
ধ্বংসস্তূপের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। প্রথমে কিছুই টের পেলাম না। কিন্তু কিছুক্ষণ পর, দূরের ভাঙা দেওয়ালের ওপাশ থেকে ভেসে এলো একটা চাপা কান্নার আওয়াজ। প্রথমে খুব ক্ষীণ, তারপর ধীরে ধীরে তা স্পষ্ট হতে লাগলো।
আমার সারা শরীর হিম হয়ে গেল। সেই কান্নার মধ্যে এমন একটা গভীর বেদনা ছিল যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। মনে হচ্ছিল, কোনো হারিয়ে যাওয়া আত্মা তার কষ্টের কথা জানানোর চেষ্টা করছে।
আমি আর দাঁড়াতে সাহস পেলাম না। দ্রুত পায়ে সেখান থেকে চলে এলাম। সেই রাতের কান্নার আওয়াজ আজও আমার কানে বাজে।
পরের দিন সকালে আমি গ্রাম ছেড়ে চলে আসি। সেই জমিদার বাড়ির রহস্য আর আমার কাছে অজানাই রয়ে গেল। তবে একটা বিষয় আমি বুঝেছিলাম, পৃথিবীতে এমন অনেক বেদনা জমা হয়ে থাকে যা মৃত্যুর পরেও মুক্তি পায় না। সেই অভিশপ্ত জমিদার বাড়ির ধ্বংসস্তূপ যেন তেমনই এক বেদনার নীরব সাক্ষী।
বহু বছর পর, একটি পুরনো জার্নালে আমি সেই জমিদার বাড়ির ইতিহাস পড়ছিলাম। সেখানে লেখা ছিল, জমিদারের স্ত্রীর নাম ছিল মাধুরী। সে নাকি খুবই দয়ালু আর শান্ত প্রকৃতির মহিলা ছিল। তাকে তার স্বামী অন্যায়ভাবে সন্দেহ করত। জার্নালে তার শেষ দিনের কিছু কথা লেখা ছিল – "আমি কোনো ভুল করিনি। কেন আমার সাথে এমন হচ্ছে?"
এই কথাগুলো পড়ার পর আমার কাল রাতের সেই নারী মূর্তির করুণ মুখের কথা মনে পড়লো। তার সেই "কে তোমরা?" বলার ধরণ, সেই "চলে যাও" বলার আকুতি – সবকিছু যেন মাধুরীর অসহায় আর্তনাদ ছিল।
আমি বুঝতে পারলাম, আমরা হয়তো সত্যিই মাধুরীর আত্মার দেখা পেয়েছিলাম। যে আত্মা তার উপর হওয়া অবিচারের কথা কাউকে বলতে পারেনি, হয়তো আমাদের দেখেই সে তার বেদনার কিছুটা প্রকাশ করতে চেয়েছিল।
আজও যখন পূর্ণিমা রাত আসে, আমার সেই পুরনো জমিদার বাড়ির কথা মনে পড়ে। মনে হয়, দূরে কোথাও হয়তো এখনও কোনো অভিশপ্ত আত্মা তার মুক্তির জন্য অপেক্ষা করছে। আর সেই নীরব ধ্বংসস্তূপ তার বেদনার নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এই ঘটনার পর থেকে আমি ভূতের গল্প শোনা বা বলার সাহস আর পাইনি। কারণ আমি জেনে গেছি, কিছু গল্প শুধু গল্প নয়, সেগুলো হয়তো না বলা কোনো সত্যির প্রতিচ্ছবি। আর সেই সত্যিরা রাতের অন্ধকারে আমাদের চারপাশেই ঘুরে বেড়ায়, শুধু আমরা তাদের দেখতে পাই না বা অনুভব করতে পারি না।
তবে সেই রাতে, পূর্ণিমা চাঁদের আলোয়, পুরনো জমিদার বাড়ির ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে আমি সেই না বলা সত্যির কিছুটা অনুভব করতে পেরেছিলাম। আর সেই অনুভূতি আজও আমাকে তাড়া করে ফেরে।
কে জানে, হয়তো কোনো এক পূর্ণিমা রাতে, অন্য কোনো গ্রামে, অন্য কোনো পুরনো বাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আপনিও তেমনই কোনো না বলা সত্যির মুখোমুখি হবেন। অপেক্ষা করুন, আর অনুভব করার চেষ্টা করুন। হয়তো তারা তাদের গল্প বলার জন্য কারও অপেক্ষাতেই আছে।
0 Comments