ভয়: ধনেশ্বরীর নীচঘর
রাত তখন আড়াইটা। নিঃশব্দ গ্রাম ধনেশ্বরী যেন নিঃশ্বাস ফেলাও ভুলে গেছে। জনশূন্য রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে সেই পরিত্যক্ত বাড়ি — “ব্রজেন্দ্র ম্যানশন।” সাদা রঙের প্রাচীন দোতলা কাঠের সেই বাড়িটা এখন একটুকুও সাদা নয়, কেবল ধূসরতা আর শ্যাওলার দখলে। কেউ বলে, ব্রজেন্দ্রবাবুর স্ত্রী আত্মহত্যা করেছিলেন এই বাড়ির নীচঘরে। কেউ বলে, সেটি ছিল খুন।
তিন বন্ধুর মাথায় হঠাৎ ভূতের গল্পে নেশা চেপে বসল। অর্ণব, দীপ এবং সৌরভ — সাহসী এবং একটু পাগলাটে। তারা ঠিক করল, আজ রাতটা কাটাবে সেই নীচঘরে।
অর্ণব বলল, "এইসব ভূতের ভয় আমাদের কাবু করতে পারবে না। সব গুজব। আজ আমরা সত্যিটা জানব।"
দীপ ক্যামেরা আনল। সৌরভ সঙ্গে আনল ভুট্টা আর কোল্ড ড্রিংক। হাসি-ঠাট্টা করতে করতে তারা পৌঁছে গেল ব্রজেন্দ্র ম্যানশনের সামনে।
গেট খোলা ছিল — যেন কেউ অপেক্ষা করছিল। দরজা খুলতেই এক অদ্ভুত ঠান্ডা হাওয়া এসে বয়ে গেল। ভিতরে ঢুকেই তারা বুঝতে পারল, জায়গাটা একেবারে নরমাল নয়। দেয়ালে অদ্ভুত আঁকিবুকি, ঘরের কোণে জমে থাকা গা-ছমছমে অন্ধকার, আর সেই গন্ধ — পচা ফুলের গন্ধ।
নীচঘরের দরজা আধখোলা। দীপ ভিতরে ঢুকেই চিৎকার করে উঠল, "কেউ... কেউ বসে আছে!"
অর্ণব টর্চ জ্বালিয়ে তাকাল — কিছুই নেই। সৌরভ বলল, "তুই ভয় পেয়েছিস, ও কিছু না। আলো-ছায়ার খেলা।"
তারা ভিতরে ঢুকল। ঘরটা অদ্ভুত ঠান্ডা, বাইরে গরমের রাত হলেও ভিতরে যেন বরফ জমে আছে। তারা মাঝখানে বসে ক্যামেরা অন করল, কথা বলতে লাগল ভূত নিয়ে, লোকাল কাহিনি, আর সেই মহিলার কথা — যিনি গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন।
রাত গড়াতে লাগল। হঠাৎ ক্যামেরা বন্ধ হয়ে গেল। ব্যাটারি ফুল থাকলেও কিছুতেই চালু হচ্ছে না। সৌরভ বলল, "দেখো না! মোবাইলের নেটও চলে গেছে!"
তখনই একটানা বাচ্চার কান্নার শব্দ আসতে লাগল ঘরের এক কোণ থেকে। তারা তিনজনেই স্তব্ধ। দীপ ধীরে ধীরে গিয়ে কোণায় আলো ফেলল — কেউ নেই। কিন্তু কাঁদার শব্দ চলছেই। ঘরের একদিক থেকে এখন আরেকটা আওয়াজ ভেসে এলো — চুড়ির ঝনঝন।
তিনজন একসাথে দরজার দিকে দৌড় দিল, কিন্তু দরজা বন্ধ। তালা নয়, যেন কেউ বাইরে থেকে চেপে ধরে রেখেছে।
সৌরভ চিৎকার করল, "এইটা তো কাচের দরজা ছিল! এখন এটা লোহার — এ কেমন করে হয়?"
অর্ণব দরজায় ধাক্কা দিতে লাগল, তখনই পেছনে ঠান্ডা বাতাসের সঙ্গে এক কণ্ঠস্বর — নিঃশব্দ অথচ তীক্ষ্ণ, "তোমরা আমার ঘরে কেন এসেছো?"
তিনজনেই ঘুরে তাকাল — ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা নারীমূর্তি। তার চুল ভেজা, মুখ দেখা যায় না, কিন্তু পা নেই। সে যেন ভেসে বেড়াচ্ছে।
অর্ণব চিৎকার করল, "আমরা কিছু করিনি! আমরা শুধু দেখতে এসেছিলাম!"
নারী বলল, "দেখা নয়... অনুভব করতে এসেছো?"
তারপরই চারপাশের দেয়াল থেকে রক্তের মতো তরল গড়িয়ে পড়তে লাগল। দীপ হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, চোখ ফাঁক করে রেখেও সে যেন কিছু দেখতে পারছিল না — সে কেবল বলছিল, “তুমি কে? আমাকে ছেড়ে দাও… আমি মাফ চাই!”
নারীমূর্তি সামনে এগিয়ে এল। তখন তার মুখটা দেখা গেল — অর্ধেক জ্বলন্ত, চোখ দুটো লাল আগুনের মতো। আর তারপর...
ঘোর অন্ধকার। নিঃস্তব্ধতা।
পরদিন সকালে গ্রামের লোকেরা খোঁজ করতে গিয়ে দেখে, ব্রজেন্দ্র ম্যানশনের দরজা খোলা। ঘরের মধ্যে পড়ে আছে দীপ — অজ্ঞান। অর্ণব আর সৌরভের খোঁজ নেই। পুলিশ আসে, তদন্ত হয়। কিন্তু কোন ক্যামেরা, কোন মোবাইল খুঁজে পাওয়া যায় না।
দীপ পরে কেবল এতটুকু বলেছিল, "ওখানে ও আছে। ও এখনো অপেক্ষা করছে, পরের অতিথিদের জন্য। আমরা ওর ঘরে ঢুকে পড়েছিলাম... আর ও এটা পছন্দ করেনি।"
শেষকথা:
এই গল্প এখনও ধনেশ্বরীর লোকেরা ভয় আর ফিসফাসে বলে। কেউ আর ব্রজেন্দ্র ম্যানশনের সামনে যায় না, সন্ধ্যার পর তো নয়ই। আর সেই নীচঘর — তার দরজা আজও একটু আধখোলা থাকে… যেন কেউ ডাকছে…
0 Comments