ভূতের গল্প: ছায়া বাড়ি

 

ছায়া বাড়ি


রাত তখন প্রায় সাড়ে বারোটা। দূর থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ শোনা যাচ্ছে, মাঝে মাঝে শিয়ালের হুংকার। এমন নির্জন গ্রাম, যেখানে সন্ধ্যা নামতেই দরজা বন্ধ হয়ে যায়। কেউ কেউ তো সূর্য ডোবার আগেই বাড়ির উঠানে ধূপ ধরিয়ে মন্ত্র পড়তে শুরু করে—একে বলে "ছায়া বাড়ি"র অভিশাপ।

এই বাড়ি এক সময় ছিল জমিদার হরিনাথ রায়ের। বিশাল জমিদার বাড়ি—পাঁচটা উঠান, আটটা ঘর, দোতলা বারান্দা, আর পিছনের দিকে এক পরিত্যক্ত দালান, যেখানে কেউ কোনোকালেও যায়নি। গ্রামের লোকজন বলে, সেই দালানেই নাকি বন্দি আছে ছায়া—এক অভিশপ্ত আত্মা।

প্রথম পরিচয়

অরিন্দম, শহরের ছেলে। একজন তরুণ সাংবাদিক। অদ্ভুত কিছুর খোঁজে দেশজুড়ে ঘুরে বেড়ায়। তার ইউটিউব চ্যানেল "অদ্ভুত অভিজ্ঞতা" দিনে দিনে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এই ছায়া বাড়ির গল্প শুনে সে ঠিক করল—এবার এখানেই যাবে।

কাজলপুর নামের এই গ্রামটায় পৌঁছাতে সময় লেগেছিল পুরো একদিন। বিকেলে সে পৌঁছাল—তার সাথে ক্যামেরা, কিছু রেকর্ডিং যন্ত্রপাতি, আর একটা ছোট ব্যাগ।

গ্রামের লোকজন কেউ তাকে স্বাগত জানাল না। সবাই যেন আতঙ্কে রয়েছে। শুধু একজন, বৃদ্ধ কুশল দা, গ্রামের একমাত্র সাহসী মানুষ, যিনি তাকে বলেছিলেন, “যদি সত্যিই সাহস থাকে, রাতটা দালান ঘরে কাটাও। কিন্তু সাবধান, ছায়া যদি একবার জেনে যায় তুমি ওকে দেখতে এসেছ, আর ফেরার পথ থাকবেনা।”

রাতের অপেক্ষা

অরিন্দম প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সন্ধ্যার পর সে বড়ঘর থেকে লাইভ শুরু করল। দর্শক সংখ্যা বেড়ে চলেছে। চারদিক নিস্তব্ধ, শুধুমাত্র দূর থেকে শোনা যাচ্ছে রাতজাগা পাখির ডাক।

দর্শকরা কমেন্ট করছে:
“দালান ঘরের ভেতর যাও!”
“ভয় পাচ্ছো?”
“লাইভ অফ করোনা, যা ঘটবে দেখাও আমাদের!”

অরিন্দম ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে পড়ল দালান ঘরের দিকে। রাত তখন প্রায় ১টা। বাতাস থমথমে। হঠাৎ একটা ছায়া লাফিয়ে গেল পাশের গাছের পেছনে। ক্যামেরা ধরে রাখলেও কিছু ধরা পড়ল না।

দালান ঘরের দরজাটা খোলা, অথচ কুশল দা বলেছিলেন, সেটা বহু বছর ধরে বন্ধ। অরিন্দম ঢুকল। ভেতরে একটা গা ছমছমে অন্ধকার। একটা ঘর যেন সময়ের ফাঁদে আটকে আছে। পুরনো খাট, দেয়ালে বিবর্ণ ছবি, আর মেঝেতে শুকনো রক্তের দাগ।

আত্মার জাগরণ

হঠাৎ ক্যামেরার স্ক্রিন ঝাপসা হয়ে গেল। ব্যাকগ্রাউন্ডে অদ্ভুত ফিসফিসানি। অরিন্দম ঘুরে তাকাল, কেউ নেই। কিন্তু তার গলার কাছে হঠাৎ ঠাণ্ডা নিঃশ্বাসের ছোঁয়া।

"তুমি এসেছো… অবশেষে…" —কানে আসা একটা কণ্ঠ। কিন্তু কার? নারী না পুরুষ, বোঝা গেল না।

দৃশ্য বদলে গেল। ঘরটা হঠাৎ যেন উনিশ শতকের মত সাজানো। বাইরে বাজ পড়ছে। দরজায় দাঁড়িয়ে এক নারী, সাদা শাড়ি, খালি পা, চোখে গভীর শূন্যতা।

"আমি অরুণা... আমাকে মুক্তি দাও…" —সে বলল।

অরিন্দম যেন সম্মোহিত। তার হাত থেকে ক্যামেরা পড়ে গেল। সে দেখতে পেল, একসময় এই ঘরেই জমিদার হরিনাথ অরুণাকে বন্দি করে রেখেছিলেন। তাকে দিনের পর দিন নির্যাতন করা হয়েছিল, শুধু প্রেম করার ‘অপরাধে’। এক রাতে অরুণা আত্মহত্যা করেন। তারপর থেকেই সে ফিরে আসে—প্রতিশোধ নিতে।

ভয়াবহ মোড়

ঘড়ির কাঁটা তখন ৩টা। হঠাৎ চারপাশে বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দ। ছায়া যেন ঘুরছে। দালান ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। অরিন্দম জানে না সে কীভাবে বেরোবে।

ক্যামেরা আবার চলতে শুরু করল, স্বয়ংক্রিয়ভাবে। লাইভে মানুষ দেখতে পাচ্ছে—একটা ছায়া অরিন্দমের পেছনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ কেউ কমেন্ট করছে:
"পালাও!"
"পেছনে দেখ!"
"দ্রুত দালান ছেড়ে বেরিয়ে পড়ো!"

কিন্তু তখন দেরি হয়ে গেছে। ছায়াটা ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে এল।

"তুমি দেখতে চেয়েছিলে, না?" —আবার সেই কণ্ঠ।

অরিন্দমের চিৎকার শুনে গ্রামের কয়েকজন ভোরবেলা এসে তাকে অচেতন অবস্থায় খুঁজে পেল। তার মুখ পুরো সাদা, চোখ কোটরের ভেতরে। কিন্তু সে বেঁচে ছিল।

পরিণতি

এক মাস পর, অরিন্দমের ভিডিও ইউটিউব-এ ভাইরাল। কিন্তু সে আর কিছু বলতে পারে না। ডাক্তার বলছে, সে ট্রমায় রয়েছে। কথা বলে না, কেবল চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে তার ঠোঁট ফিসফিস করে—"ছায়া… মুক্তি… ছায়া…"

গ্রামের লোক বলছে, অরিন্দম আসলে ছায়ার কাছে কিছু জেনে ফেলেছে, যা কেউ জানার কথা নয়। সে আর কখনো ঠিক হবে না।

ছায়া বাড়ি আজও দাঁড়িয়ে আছে, সময়ের বিপরীতে। মাঝে মাঝে রাতে ভেসে আসে এক নারীর কান্না, আর এক যুবকের ফিসফাস—“আমি দেখতে চেয়েছিলাম...”


শেষ কথা

“ছায়া বাড়ি” একটি গল্প নয়, এটি একটি অভিজ্ঞতা। সাহস থাকলে, আপনি নিজেই একদিন যেতে পারেন সেখানে। তবে মনে রাখবেন, সব কৌতূহল ভালো না, কিছু সত্য জানলে ফেরার পথ থাকেনা...

Post a Comment

0 Comments